নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে অন্তর্বর্তী সরকার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহশৃঙ্খল তদারক ও পর্যালোচনার জন্য গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু করেছে। এতে বাজারে ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ডিমের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনে ২০ থেকে ২৫ টাকা কমেছে। এতে ক্রেতাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এবার অসময়ে বন্যার ফলে দেশের প্রায় ২৬টি জেলায় আমন ধান এবং শাক-সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই কৃষকরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম জাতের সবজি চাষ শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন সবজি ক্ষেত পরিচর্চায় কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। রাজশাহী বগুড়াসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের হাটবাজারে ইতোমধ্যে শীতের আগাম সবজি আসতে শুরু করেছে। দেশের অন্যান্য জেলাতেও আগামী পনের থেকে বিশ দিনের মধ্যে আগাম জাতের শীতের সবজি বাজারে চলে আসবে। তখন বাজারের সবজির সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে এর দামও সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গতকাল দেখা যায়, ফার্মের মুরগীর ডিম প্রতি ডজন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
শাহজাহানপুরের এক বাসিন্দা বলেন, ১৫০ টাকায় ফার্মের মুরগীর এক ডজন ডিম কিনেছি। গত সপ্তাহের শুরুতে ডজন ১৮০ টাকায় কিনেছিলাম। সরকার শুধু দাম বেঁধে দিলে হবে না। নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে কঠোর নজরদারী থাকতে হবে।
শান্তিনগর বাজারের ডিম বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, গত মাসে দেশে অতি বৃষ্টি ও বন্যায় বিভিন্ন জেলায় মুরগীর খামারের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় এর উৎপাদন কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় মানুষের মনে অনেকটা স্বস্তি থাকায় ডিম, মুরগী এসব পণ্যের চাহিদা কিছু বেড়ে যায়। এর ফলে ডিমের দাম, মুরগীর দাম কিছুটা বেড়ে যায়। চলতি সপ্তাহে আমদানি করা ডিম যেমন এসেছে তেমনি খামারে আবার উৎপাদনও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এর ফলে বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে। আগামী সপ্তাহে এটা আরও কমতে পারে। ডিমের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। সেই সঙ্গে ডিমের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সাথে ডিম আমদানিতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই শুল্ক সুবিধা থাকবে।
এদিকে সরকার টাস্কফোর্স গঠনের পর সরবরাহ বাড়ানো ও দর নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় ডিমের প্রধান দুই পাইকারি বাজার তেজগাঁও ও কাপ্তান বাজারে প্রতিদিন ২০ লাখ ডিম সরবরাহ করার কথা বলেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। কাপ্তান বাজারে গত শুক্রবার থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিম সরবরাহ শুরু করেছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের অনুমান মতে, প্রতিদিন দেশে ডিমের চাহিদা ৪ কোটি আর উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে চার কোটি। তবুও ডিমের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। আবার অনেকে এর জন্য সিন্ডিকেট দায়ী বলে মনে করছেন। সরকার এই বাজার সিন্ডিকেটকে ভাঙতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং তাদের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এদিকে সবজির বাজারেও গত সপ্তাহের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। গত সপ্তাহে বরবটি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গতকাল বিভিন্ন বাজারে ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। চিচিংগা গত সপ্তাহে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, গতকাল তা বিক্রি হয় ৫০ টাকা কেজি দরে। আলুর দাম গত দুই মাস যাবত স্থিতিশীল রয়েছে। করলা গত সপ্তাহে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। লাউ, টামাটো, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, কচুর লতি, কচুরমুখি, পেঁপে, শশা সব ধরনের সবজির দামই গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
বিক্রেতারা জানান, বাজারে চাহিদার তুলনায় সবজির সরবরাহ এখনো কম। গত কয়েক মাসে দেশে বন্যা-বৃষ্টির কারণে সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অসময়ে বৃষ্টি ও বন্যা না হলে আগাম জাতের সবজি এখন বাজারে পাওয়া যেত। বন্যা বৃষ্টির কারণে আগাম সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন জেলায় কৃষক আগাম জাতের সবজি চাষ করেছে। আগামী পনের বিশ দিনের মধ্যে এসব আগাম জাতের সবজি বাজারে চলে আসবে। তখন সবজির দামও অনেকটা কমে যাবে।
এদিকে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষদের স্বস্তি দিতে সরকার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে কম দামে সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। ট্রাকে ছয় পণ্য কেনা যাচ্ছে ৫২০ টাকায়।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ডিম, আলু, পেঁপে, পিয়াজ, পটল, শসা এই ছয়টি পণ্য রাজধানী ঢাকায় ওএমএস বা খোলাবাজারে বিক্রি কার্যক্রমের আওতায় বিক্রি শুরু হয়েছে। সরকারি এ কর্মসূচি চালুর পর গত তিন চারদিনে ভোক্তাদের, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ট্রাকের পেছনে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে কম দামে সবজি কিনছেন মানুষেরা। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই প্রথমবারের মতো ওএমএসের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বিক্রি শুরু করেছে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদফতর।
গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় কৃষিপণ্যের ওএমএস কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এদিন রাজধানীর ২০টি স্থানে ট্রাকে করে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য বিক্রি করা হয়। এরপর ট্রাকের সংখ্যা আরও চারটি বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তাদের হিসাবে, গত চার দিনে ২০ হাজারের বেশি মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য সংগ্রহ করেছেন। ভোক্তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমে না আসা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালু রাখা এবং এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, আগামী দুই সপ্তাহ পাইলট বা পরীক্ষামূলকভাবে এ বিক্রয় কার্যক্রম চালানো হবে। এই প্রকল্প সফল হলে সবজি বিক্রির স্থান ও পরিমাণ বাড়ানো হবে।
আসলে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ এখন খুব একটা ভাবছেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে জনগণ তার প্রকৃত সুফল পেতে উন্মুখ। এ বিষয় নিয়ে গত জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়া একজনের মা তার ফেইসবুক একাউন্টে লিখেছেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, ডিম-সবজির জন্য না! সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কারে যতোদিন লাগবে ততোদিন নুন-ভাত খাবো’।